• শনিবার ২৯ জুন ২০২৪ ||

  • আষাঢ় ১৫ ১৪৩১

  • || ২১ জ্বিলহজ্জ ১৪৪৫

সাভারে নদী খাল বিল দখল চলছেই

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ২৪ জুন ২০২৪  

রাজধানীর পাশের জনপদ সাভার উপ শহরের ওপর দিয়ে বংশী, তুরাগ ও ধলেশ্বরী নদীসহ বিভিন্ন খাল বহমান। কিন্তু এ নদী ও খাল এখন কেবলই স্মৃতি। ভূমিখেকোদের গ্রাসে নদী এখন পরিণত হয়েছে ছোট খালে। কেননা নদীর দুই পাশের শত শত বিঘা জমি দখল করে নিয়েছে এলাকার প্রভাবশালীরা।

সম্প্রতি সাভারে অবস্থিত তিনটি খাল (তেঁতুলঝোড়া, যোগী-জাঙ্গাল ও নয়নজুলী) এবং দুইটি বিলের (তাঁতি বিল, শুকনা বিল ও রইপতা বা নোয়াদ্দা বিল) মূল প্রবাহ অনুযায়ী সীমানা নির্ধারণ করতে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ও ঢাকা জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। একই সঙ্গে এসব খাল ও বিল পুনরুদ্ধারের জন্য দখল ও দূষণকারীর তালিকা প্রস্তুত করতেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) করা এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো. আতাবুল্লাহর দ্বৈত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই আদেশ দেন। এছাড়া খাল ও বিল দখল এবং দূষণকারীদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এবং এ সংক্রান্ত সময়ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা তৈরি করতে বিবাদীদের নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। আদালতের এই আদেশ বাস্তবায়ন করে হাইকোর্টে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।

অন্যদিকে ঢাকা জেলাধীন সাভার উপজেলার ইয়ারপুর ইউনিয়নের ইছরকান্দি, মনোসন্তোষ ও সাতাইশকান্দি মৌজায় প্রায় ৬০০ একর আয়তনের একটি বিল রয়েছে, যা স্থানীয়ভাবে ‘গজাইরার’ বিল নামে পরিচিত। বিলটির দৈর্ঘ্য প্রায় ১০ কিলোমিটার ও প্রস্থ ৪ কিলোমিটার। বিলটি রক্ষায় ‘উত্তরণ প্রোপার্টিজ লিমিটেড’ ও ‘অ্যাচিভ করপোরেশন’ নামক আবাসন কোম্পানির অননুমোদিত আবাসন প্রকল্পের জন্য মাটি ভরাট, প্লট বিক্রয়সহ সব কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে আদালত। একইসঙ্গে আদালতপ্রদত্ত উল্লিখিত নির্দেশ প্রতিপালন সংবলিত প্রতিবেদন আদালতে দাখিলের জন্য রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চেয়ারম্যান, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এবং ঢাকা জেলার জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দিয়েছেন। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) কর্তৃক দায়েরকৃত একটি জনস্বার্থমূলক মামলার প্রাথমিক শুনানি শেষে সম্প্রতি বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম এবং বিচারপতি মো. আতাবুল্লাহর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বিভাগের ডিভিশন বেঞ্চ এ আদেশ প্রদান করেন।

সাভার উপজেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত বংশী, ধলেশ্বরী ও তুরাগ নদীগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে অসংখ্য খাল, বিল ও জলাশয়। যার মধ্যে জামুরমুচিপাড়া মৌজায় তেঁতুলঝোড়া খাল, কান্দিবলিয়ারপুর, চান্দুলিয়া মৌজায় বামনী খাল; পাথালিয়া মৌজায় যোগী-জাঙ্গাল (জুগী জঙ্গল), নয়নজুলী খাল, চারিগাঁও ও চাকরগাঁও মৌজায় তাঁতি বিল (শুকনা বিল) ও বড়ওয়ালিয়া ও মোহনপুর মৌজায় রইপতা (নোয়াদ্দা) উল্লেখযোগ্য। এ খাল ও বিলগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ২০টি গ্রামের লক্ষাধিক গ্রামবাসীর জীবন ও জীবিকা। একসময় কৃষিনির্ভর সাভারবাসী সেচের জন্য অনেকাংশেই এসব খাল ও বিলের পানির ওপর নির্ভরশীল ছিল। অবৈধ খদলদারিত্ব ও দূষণে জনগুরুত্বপূর্ণ এসব খাল, বিল ও জলাশয়গুলো বর্তমানে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। এসব খাল ও বিলের অংশবিশেষ ভরাট করে নির্মাণ করা হয়েছে বাড়িঘরসহ নানা স্থাপনা। গৃহস্থালি বর্জ্য ফেলার পাশাপাশি শিল্প মালিকরা তাদের শিল্পকারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য ফেলার স্থান হিসেবে ব্যবহার করছে উল্লিখিত খাল ও বিলসমূহকে।

সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের চোখের সামনেই এভাবে নদী খাল দখল হলেও তারা দেখেও না দেখার ভান করছেন। ফলে প্রভাবশালীদের নদী ও জলাশয় দখল চলছেই । হাউজিং ব্যবসার প্রতারণার শিকার হচ্ছে হাজার হাজার নিরীহ মানুষ। বংশী, তুরাগ ও ধলেশ্বরী শাখা নদী ও একাধিক খালের তীর দখলের প্রতিযোগিতা অব্যাহত রেখেছে ভূমিদস্যুরা। এলাকার বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তি ও হাউজিং কোম্পানিগুলো প্রশাসনকে ম্যানেজ করে এ দখল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তুরাগ, বংশী, ধলেশ্বরী নদী দখলমুক্ত করার জন্য বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন বিভিন্ন সময়ে মিছিল, মানববন্ধন, সমাবেশ করলেও কোনোভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না এ দখল প্রক্রিয়া।

এক কালের সাভারের বন্দর নামে পরিচিত নদীর কুল ঘেঁষে অবস্থিত সাভারের নামা বাজার আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে, আর ক্ষুদ্র হচ্ছে বংশী নদী। কেননা বাজারের প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা নদীর জমি দখল করে সেখানে নির্মাণ করছে দোকানপাট , মালামাল রাখার গুদামঘর , চিড়া ও তেলের মিল, ডাল মিলসহ অন্যান্য কলকারখানা। বাজারের এসব প্রভাবশালী নদীর জায়গা দখল করে দোকানপাট মিল কলকারখানা বসিয়ে লাভবান হচ্ছেন আর সংশ্লিষ্ট প্রশাসন ব্যবসায়ীদের নামে অবৈধভাবে জমি লিজ দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।

একটি সূত্র জানায়, সরকারি সম্পত্তি দখলে বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তি ভূমি অফিসের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ম্যানেজ করে ভূমি দখলের প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে। অনেক সরকারি সম্পত্তির ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে ভূমি অফিসের সহায়তায় দখল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি নিজেদের দখলে নিয়েছেন। সাভার বাজারের পাশে বংশী নদীর পাড় ঘেঁষে সরকারি জমি (খাস জমি) নামে-বেনামে এবং লিজের মাধ্যমে বেদখল হয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যেই সিংহভাগ জমিই বেহাত হয়ে গেছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ বেহাত হয়ে যাওয়া সম্পত্তি উদ্ধারে অজ্ঞাত কারণে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। বর্তমানে বংশী নদীর তীর ঘেঁষে এ দখল প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে।

সাভার পরিবেশ উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি ড. রফিকুল ইসলাম মোল্লা বলেন, প্রভাবশালী কর্তৃক নদী দখল হয়ে যাচ্ছে। তিনি নদী সুরক্ষায় সিএস নকশা আনুযায়ী নদীর সীমানা নির্ধারনের দাবি জানান। সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) সাভারের সভাপতি অধ্যাপক দীপক কুমার রায় বলেন, ‘পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্যই নদনদী রক্ষা প্রয়োজন। ক্রমাগত নদী খাল ভরাট হলে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে।’  এ ব্যাপারে সাভার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাহুল চন্দ বলেন, ‘উচ্ছেদ অভিযান চলমান রয়েছে। পর্যায়ক্রমে অবৈধ দখলকারীদের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালিত হবে। এছাড়া নদী, খাল, জলাশয় ভরাটের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে অবশ্যই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’